নেদারল্যান্ডসে গবেষণা: বর্ণময় কিছু অভিজ্ঞতা!

নেদারল্যান্ডসে গবেষণা: বর্ণময় কিছু অভিজ্ঞতা!

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী: আমরা (আমি ও আমার স্ত্রী) যখন আমস্টার্ডামে থাকতাম (১৯৮৪ - ৮৬)। সেইসময় ওখানে আমাদের সঙ্গে একজন শিল্পীর খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তার নাম উস্তাদ জামির আহমেদ খান। উনি খুব ভালো সেতার বাজাতেন। তার বাবা উস্তাদ মুনির খান দিল্লী রেডিও স্টেশনের 'staff artist' ছিলেন। উনি এসরাজ বাজাতেন। উস্তাদ মুনির খানের বাবা ছিলেন বিখ্যাত খেয়াল গায়ক উস্তাদ ফৈয়জ খান।

জামির আহমেদ খান ও তার ওলন্দাজ (Dutch) স্ত্রী Freeda আমস্টার্ডামে একটি বিশাল বাড়িতে থাকতেন। প্রায় প্রত্যেক weekend এই  আমাদের একটা বড় get-together হতো জামিরের বাড়িতে। জামির নিজে এসে আমাদের নিয়ে যেতেন তার বাড়িতে। খুব ভালো খাওয়াদাওয়া হতো সেখানে। আমরা আমস্টার্ডাম ইউনিভার্সিটির নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট গুলোর একটিতে থাকতাম‌। ১১ তলার উপরে ছোট্ট ফ্ল্যাট কিন্তু অসম্ভব সাজানো-গোছানো (fully-furnished) ছিল। বিরাট কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যেত হল্যান্ডের বিখ্যাত Ajax ফুটবল ক্লাবের মাঠ। দেখতে পেতাম ঐ ফুটবল টিমের প্লেয়ারদের অনুশীলন করতে।

উস্তাদ জামির আহমেদ খানের বাড়িতে গানবাজনার আসর বসতো। জামির সেতার বাজাতেন আর আমি তবলায় সঙ্গত করতাম। আমি একটানা বহুদিন তবলা শিখেছি লখনৌ ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী পন্ডিত সামতা প্রসাদের কাছে। সৌভাগ্যক্রমে অতীতে বেশ কিছু বড় বড় শিল্পীদের সাথে তবলা সঙ্গত করার সুযোগও হয়েছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খেয়ালগায়ক উষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী স্বপন গুপ্ত, বাণী ঠাকুর প্রমুখ। চাইলে গবেষণা বা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তবলার চর্চাটুকু হয়তো রাখতে পারতাম কিন্ত যে কোন কারণেই হোক হয়ে ওঠেনি।

সেই সময় দেখেছি, জামির আহমেদের সাথে আমাদের দেশের অনেক বড় বড় শিল্পী দের বেশ জানাশোনা ছিল। সেই সুবাদে তার বাড়িতে অনেকেই এসে থাকতেন। যেমন : উস্তাদ বিসমিল্লা খান (সানাই), পন্ডিত  ভি জি যোগ (বেহালা), উস্তাদ বিলায়েত খাঁ (সেতার), কিশোরী আমোনকর (কন্ঠসঙ্গীত), সুনন্দা পট্টনায়েক (কন্ঠসঙ্গীত), হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া (বাঁশি), উস্তাদ ফহিমুদ্দিন খান ডাগর (ধ্রুপদ শিল্পী), বলরাম পাঠক (সেতার), পন্ডিত শঙ্খ চট্টোপাধ্যায় (তবলা), প্রমুখ। তাদের মধ্যে একমাত্র পন্ডিত শঙ্খ চট্টোপাধ্যায়ই প্রবাসী ছিলেন। তিনি জার্মানির বার্লিনে থাকতেন এবং সেখানে তবলার একটি বিরাট স্কুল পরিচালনা করতেন। জামির আহমেদের কল্যানে তাদের সবার সাথেই আমাদের আলাপ বা কিছুটা অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। পরে পন্ডিত শঙ্খ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে আমার কিছুটা ব্যাক্তিগত সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল। উনি পরে একবার কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

জামির আহমেদ খান প্রত্যেক বছর আমস্টার্ডামের বিখ্যাত Concert Hall (Concertgebouw) এ Indian Classical Music এর প্রোগ্রাম organise করতেন। আমরা হল্যান্ডে তিন বছর থাকার ফলে এই ধরনের প্রোগ্রামের সঙ্গে আমরা একরকম একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। এই প্রোগ্রামগুলোতে আমার স্ত্রী অনিবার্যভাবে প্রত্যেক বড় বড় শিল্পীদের সাথে তানপুরায় সহযোগিতা করতো। ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বেনারস ঘরানার প্রখ্যাত শিল্পী পন্ডিত দামোদর মিশ্র ও তার সুযোগ্য পুত্র পন্ডিত মোহনলাল মিশ্রের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছে। এছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে স্বনামধন্য শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের কাছে।

আমি পোষ্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করছিলাম আমস্টার্ডামের FOM (Foundation-on-Matter) - Institute for Atomic & Molecular Physics এ। পৃথিবী-বিখ্যাত এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান টি "Molecular Physics" এবং "Condensed Matter Physics" এর গবেষণায় পৃথিবীর সেরা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া "Laser spectroscopy" এর laboratory ছিল অত্যাধুনিক, একেবারে state-of-the-art!

আমি গবেষণা করতাম "Optics for Soft X-rays to Extreme Ultraviolet" এর ওপর। একেবারেই মৌলিক গবেষণা!  ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের বর্ণালীর এই বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘের (X-UV) অংশটুকুর (4.5 ন্যানোমিটার - 20 ন্যানোমিটার) ক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটানো টাই ছিল তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই তরঙ্গদৈর্ঘের রেঞ্জে absorptivity এতটাই বেশি যে reflectivity প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আলোর প্রতিফলনই যদি না হয়, প্রতিবিম্ব গঠন কিভাবে সম্ভব হবে?

সুতরাং কোনরকম imaging device ছিল না এই তরঙ্গদৈর্ঘের আলোর ক্ষেত্রে। আমরাই প্রথম এই পরিসরের তরঙ্গদৈর্ঘের আলো কে প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত করতে পেরেছিলাম এক বিশেষ ধরনের কৃত্রিম কেলাস ( pseudo-crystal) তৈরি করে যার দ্বারা ঐ নির্দিষ্ট পরিসরের কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ কে প্রায় normal incidence এ প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের এই পদ্ধতি টি অত্যন্ত জটিল ছিল এবং ইকুইপমেন্ট টিকে আমরা পুরোপুরি কম্পিউটার-কনট্রোল্ড করতে পেরেছিলাম। এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিল নেদারল্যান্ডসের 'ফিলিপ্স রিসার্চ লেবরেটরী'। এই Soft X-ray mirror তৈরীতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলাম তার নাম "Layered Synthetic Microstructure fabrication process"; সফ্ট এক্স-রে টেলিস্কোপ ও সফ্ট এক্স-রে মাইক্রোস্কোপ তৈরিতে যে লেন্স ব্যবহার করা হয় তার গঠন এই মাইক্রোস্ট্রাকচারের ওপর ভিত্তি করেই।  

আমাদের এই নতুন পদ্ধতিটি আন্তর্জাতিক স্তরে অসম্ভব সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। SPIE (Society of Photo - Instrumentation Engineers) আয়োজিত আমেরিকার San Diego তে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এই বিষয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এবং আমার সেই 'আমন্ত্রিত বক্তৃতা' টি SPIE কনফারেন্সে খানিকটা সারা ফেলে দিয়েছিল। সেই বছরই (১৯৮৫) নেদারল্যান্ডসের 'ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি' আমাদের এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করে প্রথম "সফট এক্স-রে টেলিস্কোপ" নির্মাণ করে যার সাহায্যে প্রথম সূর্যের করোণার (solar corona) ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। ফোম-ইনস্টিটিউটে "Soft x-ray reflecting device"  তৈরি করার যন্ত্রটির সাথে আমাকে দেখা যাচ্ছে একটি ছবিতে। এই ধরনের অভিনব যন্ত্র নির্মাণে আমরাই পথপ্রদর্শক (pioneering) ছিলাম।

বেশ কয়েক বছর আগে জার্মানির ইয়েনা (Jena) শহরে ফ্রেডরিক শিলার ইউনিভার্সিটি তে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। এক্স-রে অপটিক্স রিসার্চে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইকারহার্ট ফর্সটার একেবারে প্রথম সারির বিজ্ঞানী ছিলেন। ওখানে সফট এক্স-রে অপটিক্সের উপর আমি বেশ কয়েকটি লেকচার দিয়েছিলাম। কথায় কথায় তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে আমাদের সফট এক্স-রে সম্পর্কিত নেদারল্যান্ডসের গবেষণা জার্মানীর প্রায় সব কটি অপটিক্স লেবরেটরীতে উচ্চ প্রশংশিত। অধ্যাপক ফরস্টার আরেকটি কথাও বলেছিলেন যে এ বিষয়ের উপর প্রকাশিত আমার একটি বিশদ গবেষণা-প্রবন্ধ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একরকম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। একথা শুনে খুশি হয়েছিলাম।  ইয়েনা জার্মানীর গর্ব। মিউনিখ থেকে বার্লিনগামী রেলপথের মোটামুটি মাঝামাঝি অবস্হানে Jena ষ্টেশন। 'থুরিঙ্গিয়া' প্রভিন্সের অন্তর্ভুক্ত এই শহরটির এক পাশে‌ এরফুর্ট আরেক পাশে লাইপজিগ। Jena তে পৃথিবী-বিখ্যাত "Zeiss Lens" তৈরি হয়। তাই অনেকে শহরটিকে "City of Optic-Glass" বলে থাকে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল Zeiss factory পরিদর্শন করবার!

এবার নেদারল্যান্ডসের বিষয়ে আবার ফিরে আসা যাক। আমস্টার্ডামের ফোম-ইনষ্টিটিউট একবার ওদের বার্ষিক ক্রীসমাস-অনুষ্ঠানে আমার স্ত্রীকে গান গাইতে অনুরোধ করেছিল। আমার স্ত্রীর সম্মতি পেয়ে ওরা যার পর নেই আনন্দিত হয়েছিল। ওকে অনুষ্ঠানের দিন বিশেষ ভাবে সম্মানিত করেছিল। অনুষ্ঠানে‌র শুরুতে আমি ওর গাওয়া প্রতিটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সারাংশ ইংরেজীতে তর্জমা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম শ্রোতৃবৃন্দকে। গানের কথা যে এত উঁচু ভাবনার হতে পারে তা বোধহয় তারা সেদিন হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। স্ত্রীর গানের সঙ্গে তবলা সঙ্গতে আমিই ছিলাম। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে একটি হারমোনিয়াম ও একজোড়া বায়া-তবলা আমস্টার্ডামের 'Indian Musium' থেকে কেউ একজন‌ জোগাড় করে রেখে দিয়েছিল আগের থেকেই। আমার স্ত্রীর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মুগ্ধতার শেষ ছিলনা।

সেই অনুষ্ঠানে "আমস্টার্ডাম রেডিও" ষ্টেশনের এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তার নাম ছিল Franck Meller; যিনি অনুষ্ঠানের শেষে আমাদের কাছে এক অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব পেশ করলেন। বললেন, আমার স্ত্রীকে আমস্টার্ডাম রেডিওতে গাইতে হবে। আমি হতচকিত হয়ে বললাম, ও তো শুধু বাংলা গান গায় এবং সেটা একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওর গুরুর নাম সুচিত্রা মিত্র। Franck বললো, অসুবিধে নেই। নেদারল্যান্ডসে প্রচুর বাঙালি বাস করে তারা শুনবে। আপনার স্ত্রী খুব ভালো গান করেন তাই তাকে নিয়ে রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করতে চাই। তাছাড়া আমরা এই অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে আগের থেকে বার বার রেডিওতে প্রচার করবো।

এর মাসখানেকের মধ্যেই আমাদের সেই লাইভ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানটি আমস্টার্ডাম রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। আমার স্ত্রীর কন্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আমার তবলা সঙ্গত আমাদের এই দ্বৈত রেডিও প্রোগ্রাম-সমগ্র নেদারল্যান্ডসের বাঙালি-মহলে আমাদেরকে সুপরিচিত করে দিয়েছিল অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। ফলত: মাঝে মাঝেই আমাদের ডাক পড়তো Rotterdam, Eindhoven, Delft, Hilversum, Utrecht, Gronningen... ইত্যাদি শহরের বাঙালিদের কাছ থেকে।

Professor Jacob Kistemaker আমার কাছে সাক্ষাৎ ঈশ্বর ছিলেন। তার পান্ডিত্য ছিল আকাশছোঁয়া। কলকাতার সাহা ইনষ্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পি-এইচ-ডি করার সময় তার যুগান্তকারী গবেষণাপত্র আমাকে সমৃদ্ধ করেছে নানা দিক দিয়ে। "Atomic Collisions in Solids" বিষয়ের ওপর আমার এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চ-থিসিসের ফরেন এক্সামিনার তিনিই ছিলেন। আমি এই বিশেষ এক্সপেরিমেন্টগুলো করার জন্য সাহা ইনষ্টিটিউটের লেবরেটরীতে একটি "রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি কোয়াড্রুপোল মাস-স্পেকট্রোমিটার" তৈরি করেছিলাম সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাধারা প্রয়োগ করে। ভারতবর্ষে প্রথম এই ধরনের অভিনব 'মাস-স্পেকট্রোমিটার' তৈরি করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ‌‌'প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলারশিপ' ও "মোয়াট পদক"  দিয়ে সন্মানিত করেছিল। এই দুর্লভ সন্মানে সম্মানিত হবার জন্য আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার পিএইচডি সুপারভাইজার প্রফেসর শচীদুলালদের কাছে যিনি আমাকে একরকম হাতে ধরে এক্সপেরিমেন্ট করা শিখিয়েছিলেন। 

প্রফেসর জ্যাকব কিস্তেমাকার আমার থিসিস পরীক্ষা করে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি আমাকে সরাসরি ডেকে নিয়েছিলেন তার নিজের প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্রে রিসার্চ করবার জন্য। এই সুযোগ আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল এবং নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। ফোম ইনষ্টিটিউটে তার সাহচর্য ও অপরিসীম স্নেহ পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।

বিআলো/ইসরাত